শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৩ পূর্বাহ্ন
প্রথমেই বলে নিই, মানসিক দৃঢ়তা—বিষয়টার নানারকম সংজ্ঞা আছে। তবে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে,
“মানসিক দৃঢ়তা হচ্ছে এমন অনন্য ক্ষমতাশীল একটি প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে মানুষ প্রতিকূলতা, আতঙ্ক, দুঃখ ও ভয় প্রভৃতির মোকাবেলা করতে পারে। এবং কাটিয়ে উঠতে পারে—পারিবারিক ও সম্পর্কজনিত সমস্যা, শারীরিক অসুস্থতা বা কর্মক্ষেত্রের জটিলতা এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপও । কীভাবে মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে, নিজের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে, জীবনের দুঃসময় কাটিয়ে ওঠে এবং বিক্ষুব্ধ ঝড়-ঝাপ্টায়ও নিজেকে প্রশান্ত ও স্থির রাখতে সক্ষম হয়—এসব বোঝাতেই মূলত ‘মানসিক দৃঢ়তা’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়।”
এবার মূল আলোচনায় আসি। যখন পরিস্থিতি ভালো চলছে, আপনার জীবন স্বাভাবিকভাবেই বয়ে চলছে, আর আপনিও কোনো জটিলতার শিকার হচ্ছেন না; তখন আপনি কী করবেন? আমার পরামর্শ হচ্ছে—আপনি বর্তমানের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করুন। বেশি বেশি দান-সদকা করুন। গরিব ও দুস্থদের সহায়তায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করুন। এসব ধাপ অতিক্রম করার পর আপনি আগামী দিনগুলোতে কী কী সমস্যা ও জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন, সেটা নিয়ে চিন্তা করুন, ভাবুন…
সময়গুলো খু-ব ভালোই কাটছে, পরিবারের সবাই উৎফুল্ল, অতিবাহিত হওয়া প্রতিটি মুহূর্তই আনন্দঘন অবস্থায় যাচ্ছে। আপনি ক্যারিয়ারের একটি ভালো জায়গায় অবস্থান করছেন, সুস্থ আছেন এবং আপনার প্রিয়জনেরা ভালো আছে। আর আপনার সম্পর্কগুলোও অনেক বেশি দৃঢ়… চমৎকার! এখন কী করবেন? প্রথমেই সেই মহান সত্তার শোকর আদায় করুন, যিনি আপনাকে, আপনার পরিবারকে এবং আপনার প্রিয়জনদের ভালো ও স্বাচ্ছন্দ্যে রেখেছেন। তারপরের ধাপে আপনাকে চিন্তা করতে হবে—আপনার এই ভালো সময়গুলো যে মুহূর্তের মধ্যেই বিষণ্ণতার রূপ নিতে পারে, আপনার জীবনে নেমে আসতে পারে অন্ধকার—এসব। এসব ভেবে আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন সবধরনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার। নিজের ভেতর স্থিরতা এবং মানসিকভাবে দৃঢ়তা অর্জন করুন!
অবশ্য আমার এ পরামর্শ শুনতেই আপনার বাজে মনে হতে পারে। হলে অবশ্য আমি অবাক হব না। বরং বলব—হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারেন, ‘অযথা এসব ভেবে চিন্তিত হব কেন?’ এরচেয়ে ভালো খারাপ ও প্রতিকূল সময়গুলো আসার অপেক্ষা করি। তখন সময়ই বলে দিবে, কীভাবে তা মোকাবেলা করতে হবে! এখন অযথাই এসব নিয়ে চিন্তিত হয়ে মনস্তাপে ভোগার কোনো অর্থই হয় না… প্রতিউত্তরে আমি আপনাকে বলব—আরে ভাই! আপনাকে ভাবতে আর চিন্তা করতে বলেছি কেবল। যাতে আপনি প্রয়োজনীয় ও সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিয়ে রাখতে পারেন। আপনাকে তো আমি দুশ্চিন্তা বা দুর্ভাবনায় মাথা ফাটাতে বলিনি! বলিনি, আপনি চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ করে ফেলেন?
আপনাকে আমি বলেছি কেবল চিন্তা-ভাবনার কথা। কারণ এখন হয়তো আপনি খুব প্রফুল্ল আছেন, খুব ভালো সময় অতিবাহিত করছেন… কিন্তু এই তো কিছুক্ষণ পর কী ঘটবে, নিশ্চয় আপনি তা জানেন না। তাই আমি বলছি—সামনের ঘটতে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করুন এবং তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য সব পন্থা মাথায় রাখুন। এর চমৎকার ফল হবে—বিপর্যয়গুলো আঘাত হানার সময় আপনি মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে পারবেন। এবং আপনার এখন যা আছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে আরো বেশি কৃতজ্ঞ হতে পারবেন। অনেকে অনেকভাবে মানসিক দৃঢ়তা অর্জনের চেষ্টা করে থাকে। আপনিও ফলপ্রসূ কোনো পন্থা অবলম্বন করুন। তারপর উপলব্ধি করতে পারবেন, মানসিক দৃঢ়তা অর্জনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার উপকারিতা কী?
মানসিকভাবে দৃঢ়তা অর্জনের জন্য নিচের এই পন্থাটাও অনুসরণ করতে পারেন :
১. নিভৃতে বসার জন্য বা শোয়ার জন্য আরামদায়ক একটা জায়গা খুঁজে নিন। তারপর সেখানে বসুন বা শুয়ে পড়ুন।
২. এবার আপনার চোখ দুটো বন্ধ করুন। নিজেকে আশপাশের কোলাহল থেকে একান্তে নিয়ে আসুন।
৩. তারপর এমন একজন ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন, যিনি আপনার খুব ঘনিষ্ঠ এবং আপনি যার উপর খুব ভরসা করেন এবং তাকে অনেক ভালোবাসেনও। তাদের সাথে কাটানো ভালো সময়গুলোর কথা কল্পনা করুন। তার সাথে থাকার ফলে আপনি যে আনন্দ অনুভব করতেন, তা এখন অনুভব করার চেষ্টা করুন।
৪. এবার কল্পনা করুন যে, আপনি কোনো ঘরে একা একা অবস্থান করছেন। আপনার ফোনে একটি কল এসেছে। রিসিভ করে শুনলেন—যে মানুষটাকে আপনি খুব ভালোবাসেন, যার কথা মাত্রই চিন্তা করছিলেন… সে ভালোবাসার মানুষটাই কিছুক্ষণ আগে অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছেন।
৫. সংবাদটা শোনার পর আপনি নিজের ভেতর প্রচন্ড রকমের একটা ধাক্কা অনুভব করবেন। আপনার চোখ দিয়ে অশ্রুও ঝরবে।
এখন আস্তে আস্তে এই অনুভূতি থেকে বের হয়ে আসার নামই কিন্তু মানসিক দৃঢ়তা। এই অনুভূতিতে কিন্তু আপনাকে আটকা পড়ে থাকার দরকার নেই। এই এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আপনি নিজের জীবনের ভারসাম্যতা হারাতে যাবেন না। আমার মূল কথা হচ্ছে, আমি আপনাকে কিছুক্ষণ পরও ঘটতে পারে—এমন সংবেদনশীল বিষয়গুলো অনুভব করার কথা বলছি। যাতে আপনি প্রতিকূল অবস্থার ধাক্কা সামলাতে পারেন এবং ধাক্কা সামলানোর মতো মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করতে পারেন।
আমার কথা এটাই যে, আপনি আশঙ্কার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবুন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে রাখুন। যাতে বিপদের সময়টাতে আপনি মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে পারেন। আর মনে রাখবেন, আশঙ্কার বিষয় কিন্তু নির্দিষ্ট নয়। সময়ের ঘূর্ণাবর্তে যে কোনো কিছু হতে পারে। যেমন—চাকরি থেকে ছাঁটাই, কারো সাথে সম্পর্কের সমাপ্তি বা ডাক্তারের কাছ থেকে দুঃসংবাদ শ্রবণ প্রভৃতি…
এবার আমার একটা বিষয় শেয়ার করি—
“আমি কিন্তু নিয়মিত আমার নিজের সব সম্পদ হারিয়ে ফেলার মতো দুর্যোগের কথা ভাবি। আমি কল্পনা করি যে, একটি ভুল জায়গায় আমার সব টাকা বিনিয়োগ করে বসেছি। আর তারা আমার সব সম্পদ মেরে দিয়ে ভেগে গেছে। আমি মনে মনে এ ধরনের অনেক কিছুই ভাবি। এখন যদি সত্যি সত্যিই এমন কিছু ঘটে, তবে তা আমার কাছে নতুন কিছু মনে হবে না। আমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আছে— আমি আবার শুরু করতে পারব…“
তাই আপনাকেও বলছি—আপনার জীবন তুলনামূলক শান্ত হলে কিংবা আপনি কোনো ভালো অবস্থানে থাকলে, সবসময় আল্লাহর শোকর করুন এবং সবসময় না হলেও অধিকাংশ সময়ই এমন চিন্তাভাবনা করুন। এতে আপনি বিপদ ও সঙ্কটের সময়গুলোতে মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে পারবেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আপনি বিপদের সময় হতাশ হবেন। এটা মানবের স্বভাবজাত বিষয়। কিন্তু আপনি যদি আগে থেকে মানসিকভাবে দৃঢ় হয়ে থাকেন, তাহলে এই বিপদ আর সঙ্কট আপনার জন্য দীর্ঘমেয়াদী হতাশার কারণ হবে না। আর আমি নিশ্চিত, এতে আপনার জীবনযাত্রারও উন্নতি হবে…
লেখক : রওশন আরা তাবাসসুম