সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭ অপরাহ্ন
অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ও মসজিদের জায়গার বিরোধ নিয়ে মামলা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচার প্রক্রিয়াধীন ছিল। গত শনিবার দেশটির শীর্ষ আদালত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
গত শনিবার গোটা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দিকে। সব কল্পনা জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সুপ্রিম কোর্ট রাম মন্দিরের পক্ষেই মামলার রায় দেন। রায়ের নির্দেশ অনুযায়ী বাবরি মসজিদের ওই ২.৭৭ একর জমির উপর তৈরি হবে রাম মন্দির। অন্যদিকে অযোধ্যাতেই মসজিদ তৈরির জন্য অন্য কোথাও ৫ একর জমি মুসলিম সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেয়া নির্দেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে হেরে গেছে মুসলিমরা। এ রায়ে ভারতের আলেমদের মধ্যেও মত পার্থক্য এবং পক্ষ-বিপক্ষ বিরোধ শুরু হয়েছে। এ রায় নিয়ে কী ভাবছেন দেশটির প্রসিদ্ধ আলেমরা।
মাওলানা আরশাদ মাদানি
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রবীণ মুহাদ্দিস ও ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ (একাংশের) আমির মাওলানা আরশাদ মাদাদি রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা চূড়ান্ত ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করেছি, করবো। আমাদের বিশ্বাস ছিলো আমাদের পক্ষ্যে বাবরি মসজিদ মামলার রায় আসবে। কারণ আমরা মজুবত দলিল প্রমাণ পেশ করেছি।
রায়ের পর তিনি ভারতের মুসলিমদের প্রতি দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও মুসলিমদের নিরাপত্তার বিষয়কে প্রাধান্য দিতে এ রায়কে পরাজয় কিংবা বিজয় হিসেবে না দেখার আহ্বান জানান।
মাওলানা মুহাম্মদ ওয়ালি রাহমানি
ভারতের বিহার ওড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ডের ইসলামি শরীয়াহ বোর্ডের প্রধান মাওলানা মুহাম্মদ ওয়ালি রাহমানি আদালতের রায় ঘোষণার পর এক বিবৃতিতে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় বেদনাদায়ক তবে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা স্বীকার করা দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য।
তিনি আরও বলেন, সারাদেশ সুপ্রিম কোর্টকে সম্মান করে। যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে এবং দেশের সর্বাধিক সম্মানিত ও সর্বোচ্চ আদালত এটি, তাই আমরা আদালতের এ সিদ্ধান্তটি মেনে নিচ্ছি। তবে সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ে আমরা অত্যান্ত মর্মাহত এবং দুঃখিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ওয়ালি রাহমানি বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিবেদনের আলোকেই রায় তৈরি করেছে। অথচ প্রত্নতাত্ত্বিকরাও বিশ্বাস করেন যে, তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্টটি অনুমানের ভিত্তিতে করা হয়েছে। সুতরাং এ মামলার রায়ও অনুমানের ভিত্তিতে করা হয়েছে। আমরা এর সুরাহা চাই।
মাওলানা গুলজার আহমদ আজমি
ভারতের জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের আইনি সহায়তা কমিটির প্রধান মাওলানা গুলজার আহমদ আজমি সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর মুম্বইয়ে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলেছেন, ‘অনেক কিছুই আমরা অপছন্দ হলেও মেনে নেই। বাবরি মসজিদ রায়ও আমাদের অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও মেনে নিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘তবে বাবরি মসজিদের জায়গার পরিবর্তে মুসলমানদের জন্য পাঁচ একর জমি ভিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন নেই। মুসলমানরা যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলের আলোকেই আদালতের কাছে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেছিল। যা পূরণ করতে পারেনি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত।
তিনি আরও বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান করি, তবে সিদ্ধান্তের মধ্যে অনেকগুলি ত্রুটি ছিল। যেগুলো নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। সুতরাং কুরআনের আদেশের দিকেই আমাদের নজর দেয়া উচিত। আল্লাহ বলেন-
‘যা তুসি অপছন্দ কর বা ঘৃণা কর, হয়ত তাতে আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য মঙ্গল রেখেছেন।’
মাওলানা সালমান নদভি
ভারতের লেখক, গবেষক, সাহিত্যিক মাওলানা সালমান নদভি মামলার রায় সম্পর্কে বলেন, ‘আমি এমন একটি রায়ের জন্যই চেষ্টা করে আসছি একবছর আগ থেকে। জনাব রবি শঙ্করের সঙ্গে মিলে আমি দেশকে মুসলিম-হিন্দু সংঘাত থেকে বাঁচাতে এমন একটি রায়ের চেষ্টা করছিলাম।
আর তাই এ মামলার জন্য উভয় পক্ষ থেকে মধ্যস্থতা কমিটি করা হয়েছিলো। তাতে আমি ছিলাম। চেষ্টা করেছি এমন একটি ফায়সালার জন্য যেনো ভারতে বাবরি মসজিদ নিয়ে বহু বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার অবসান হয়।
তিনি এ রায়ে আল্লাহ প্রশংসা করে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ঐতিহাসিক এ রায় হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ের একটি মসজিদ স্থানান্তরের ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। যেখানে বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করে মসজিদ স্থানান্তর করে খেজুর বাজার নির্মাণ করা হয়েছিল।
মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মুখপাত্র ও সেক্রেটারি মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি রায়ের পর বলেন, বাবরি মসজিদ ইস্যুতে কোর্টের ফায়সালা মেনে নিবো। কিন্তু আমাদের প্রতি ন্যায় বিচার হয়নি এটাও আমরা বলছি।
তিনি বলেন, মামলাটি শুরু হয়েছিল নিপীড়ন এবং প্রতারণার মাধ্যমে। আজ আবারও সে প্রতারণায় আমাদের থেকে মসজিদের অধিকার ছিনিয়ে নিলো আদালত। এরপরও বলবো আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশী।
মাওলানা সৈয়দ আহমেদ বুখারি
দিল্লি শাহী জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা সৈয়দ আহমেদ বুখারি রায় প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভারতের মুসলমানরা শান্তি চায়। এরই মধ্যে তারা বলেছে সর্বোচ্চ আদালতের যে রায় হবে তা মেনে নেবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা রায় মেনে নিয়েছি। বিষয়টি হিন্দু-মুসলিমদের দীর্ঘদিনের বিরোধ। এ বিরোধের অবসান হওয়া উচিত।’
এ রায়ের রিভিউ পিটিশনের ব্যাপারেও তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আর দীর্ঘায়িত করা উচিত হবে না।
সর্বোপরি ভারতের শীর্ষ আলেমদের বক্তব্য থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, বাবরি মসজিদ মামলার রায় সঠিক হোক আর না হোক হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিষ্পত্তির স্বার্থে এ রায় মেনে নেয়ায় রয়েছে কল্যাণ ও শান্তি।
আলেমদের এসব বিবৃতিতে আবারও প্রমাণিত হলো ইসলাম ও মুসলিমরাই সাম্য ও সম্প্রতি প্রতিষ্ঠায় অনন্য। এ রায় মেনে নেয়ার মধ্যেই রয়েছে মুসলমানদের সুস্পষ্ট বিজয়।